আমাদের শরীরে বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। এই রোগগুলো যখন তলপেটে হয়, তখন অনেকেই চিকিৎসকের কাছে যান না। তাই এসব রোগের ব্যাপারে সচেতনতা থাকা জরুরি। আমাদের মধ্যে অনেকেই হার্নিয়া রোগের নাম শুনেছেন, কিন্তু কীভাবে এই রোগ হয়, এর লক্ষণ কী, আর কীভাবে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়, সে সম্পর্কে অনেকেরই পরিষ্কার ধারণা নেই। এই আর্টিকেলে আমি আপনাদের পুরুষদের হার্নিয়া রোগ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলব। এই আর্টিকেলটি পড়ার পরে, আপনি হার্নিয়া রোগের সংজ্ঞা, কী কারণে এই রোগ হয়, লক্ষণ কী কী, কীভাবে এই রোগ নির্ণয় করা হয়, আর এই রোগের কী ধরনের চিকিৎসা আছে, তা সম্পর্কে জানতে পারবেন। এছাড়াও, এই রোগ প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কেও জানতে পারবেন। তাই এই আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন এবং হার্নিয়া রোগ সম্পর্কে আপনার জ্ঞান বাড়ান।
পুরুষের হার্নিয়া রোগের সংজ্ঞা
হার্নিয়া, যা সাধারণত হার্নিয়া নামে পরিচিত, একটি চিকিৎসা অবস্থা যেখানে শরীরের কোনো অংশ, সাধারণত অন্ত্র, শরীরের দেয়ালে একটি দুর্বলতা বা ফাটলের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে। পুরুষদের ক্ষেত্রে, হার্নিয়া সাধারণত পেট বা groin এ ঘটে। পেটের হার্নিয়াকে ইনগুইনাল হার্নিয়া এবং পেটের হার্নিয়াকে অন্ত্র হার্নিয়া বলা হয়। পুরুষের হার্নিয়ার কারণগুলি বৈচিত্র্যময় হতে পারে, তবে সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- ভারোত্তোলন বা ভারী বস্তু টানা
- ক্রনিক কাশি বা হাঁচি
- স্থূলতা
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- প্রস্রাবের সমস্যা
হার্নিয়া রোগ হওয়ার কারণ
হার্নিয়া রোগের প্রধান কারণ হল পেটের দেয়ালের দুর্বলতা। এই দুর্বলতার কারণে পেটের ভেতরের কোনো অঙ্গ বা টিস্যু পেটের দেয়ালের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। পেটের দেয়ালের দুর্বলতা কিছু কারণে হতে পারে, যেমন:
- গর্ভাবস্থা
- ওজন বৃদ্ধি
- ভারী বস্তু তোলা
- ক্রনিক কাশি
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- ধূমপান
এছাড়াও, কিছু জন্মগত কারণও হার্নিয়া রোগের কারণ হতে পারে। যেমন, জন্ম থেকেই পেটের দেয়ালে দুর্বলতা থাকতে পারে। এই দুর্বলতা ক্রমে হার্নিয়া রোগের কারণ হতে পারে।
হার্নিয়া রোগের লক্ষণগুলি সাধারণত ধীরে ধীরে দেখা দেয়। প্রথমে, আপনি পেটে বা কুঁচকিতে একটি ছোট ফোলা দেখতে পাবেন। এই ফোলাটি কখনো কখনো ব্যথাযুক্ত হতে পারে। যদি আপনি হার্নিয়া রোগের কোনো লক্ষণ দেখেন, তাহলে দ্রুত একজন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
হার্নিয়া রোগের লক্ষণ
পুরুষের হার্নিয়া রোগের প্রাথমিক লক্ষণটি হলো তলপেটে একটি বেদনাদায়ক বা অস্বস্তিকর ফোলাভাব। এই ফোলাভাবটি সাধারণত পেটে বা কুঁচকিতে অনুভূত হয় এবং এটি দাঁড়ানো বা কাশির মতো পেটের চাপ বাড়ানোর কার্যকলাপের সময় খারাপ হতে পারে। অন্যান্য লক্ষণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:
- পেটে টান বা ভারী অনুভূতি
- বুকে ফোলাভাব বা জ্বালা
- কোষ্ঠকাঠিন্য বা প্রস্রাবের সমস্যা
- ফোলাভাবটি শুয়ে পড়লে বা পায়ে তুলে দিলে হ্রাস পায়
গুলি এর গুরুতরতার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। ছোট হার্নিয়াসগুলি প্রায়শই কোনো লক্ষণ সৃষ্টি করে না, তবে বড় হার্নিয়াসগুলি তীব্র ব্যাথা এবং অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে। যদি আপনি পুরুষদের হার্নিয়া রোগের কোনো লক্ষণ লক্ষ্য করেন, তবে সঠিক নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য দ্রুত ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা গুরুত্বপূর্ণ।
হার্নিয়া রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি
হার্নিয়া নির্ণয়ের জন্য বেশ কিছু পদ্ধতি রয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় শারীরিক পরীক্ষা এবং রোগীর লক্ষণের বর্ণনা দিয়েই হার্নিয়া নির্ণয় করা যায়। চিকিৎসক হার্নিয়ার অবস্থান, আকার এবং ধরন নিরূপণের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন।
হার্নিয়া নির্ণয়ের জন্য সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি হল শারীরিক পরীক্ষা। এই পরীক্ষার সময় চিকিৎসক হার্নিয়ার অবস্থানে হাত দিয়ে দেখেন এবং এর আকার এবং কোমলতার বিষয়টি যাচাই করেন। হার্নিয়া প্রসারিত হয় কিনা বা হাত দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া যায় কিনা তাও দেখা হয়। এই পরীক্ষায় চিকিৎসক হার্নিয়ার পাশে কাশি বা হাঁচির মতো প্রচেষ্টা প্রদান করার জন্য বলতে পারেন। এতে করে হার্নিয়া আরও প্রসারিত হয়ে নির্ণয় করা সহজ হয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শারীরিক পরীক্ষা দিয়েই হার্নিয়ার নির্ণয় করা সম্ভব হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। যেমন:
- ইমেজিং পরীক্ষা: আল্ট্রাসাউন্ড বা সিটি স্ক্যানের মতো ইমেজিং পরীক্ষা হার্নিয়ার আকার এবং অবস্থান নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে। এটি হার্নিয়া প্রসারিত হওয়ার এবং অন্ত্রের অংশগুলো জড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নির্ণয় করতে সহায়তা করে।
- ল্যাপারোস্কপি: ল্যাপারোস্কপি হল একটি অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি যা হার্নিয়ার নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে পেটে একটি ছোট কাট তৈরি করে একটি ক্যামেরা সহ একটি ল্যাপারোস্কোপ ঢোকানো হয়। এই ক্যামেরার সাহায্যে চিকিৎসক হার্নিয়ার অবস্থান এবং আকার দেখতে পান এবং প্রয়োজনে জটিলতা নিরূপণ করতে পারেন।
হার্নিয়া রোগের চিকিৎসা
হার্নিয়ার চিকিৎসার ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারই হলো সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দুর্বল পেশীকে শক্তিশালী করে হার্নিয়া ব্যাগকে পেটের ভেতর ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং হার্নিয়ার মুখ বন্ধ করা হয়। অস্ত্রোপচার দুইভাবে করা যেতে পারে: ওপেন সার্জারি এবং ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি।
ওপেন সার্জারিতে, হার্নিয়ার উপর একটি কাটা ছেঁটে হার্নিয়া ব্যাগকে পেটে ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং দুর্বল পেশীকে জাল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারিতে, পেটে কয়েকটি ছোট কাটা তৈরি করা হয় এবং একটি ল্যাপারোস্কোপ (একটি ছোট ক্যামেরাযুক্ত একটি নল) এবং বিশেষ সরঞ্জামগুলি পেটে প্রবেশ করানো হয়। তারপর সার্জন হার্নিয়া ব্যাগকে পেটে ফিরিয়ে দেন এবং দুর্বল পেশীকে জাল দিয়ে ঢেকে দেন। ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারিটি কম আক্রমণাত্মক এবং দ্রুত সেরে ওঠে, কিন্তু এটি কিছু ক্ষেত্রে সঠিক হতে পারে না।
অস্ত্রোপচার ছাড়াও, কিছু ক্ষেত্রে র জন্য হার্নিয়া ট্রাস ব্যবহার করা যেতে পারে। হার্নিয়া ট্রাস হল একটি বিশেষ ডিভাইস যা হার্নিয়া ব্যাগকে জায়গায় রাখতে সাহায্য করে। হার্নিয়া ট্রাসগুলি সাধারণত ছোট বা মধ্যম আকারের হার্নিয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় এবং এগুলি কিছু ক্ষেত্রে অস্থায়ী সমাধান হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
হার্নিয়া রোগ প্রতিরোধের উপায়
পুরুষদের মধ্যে হার্নিয়া একটি সাধারণ সমস্যা। এটি যখন ঘটে তখন পেটের দেওয়ালের দুর্বল অংশের মধ্য দিয়ে অন্ত্র বা অন্যান্য অঙ্গ বেরিয়ে আসে। এটি ব্যাথা, অস্বস্তি এবং অন্যান্য জটিলতার কারণ হতে পারে। তবে কিছু পদক্ষেপ নিয়ে আপনি হার্নিয়া রোগ প্রতিরোধ করতে পারেন।
প্রথমত, একটি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন। অতিরিক্ত ওজন পেটের দেওয়ালে চাপ দেয় এবং হার্নিয়া রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং একটি সুষম খাদ্য খান যা ফল, শাকসব্জি এবং সম্পূর্ণ শস্য সমৃদ্ধ। দ্বিতীয়ত, ভারী বস্তু তোলার সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন। ভারী বস্তু তোলার সময় সঠিক ভঙ্গিমা ব্যবহার করুন এবং আপনার শরীরের সীমারেখা সম্পর্কে সচেতন থাকুন। তৃতীয়ত, কোষ্ঠকাঠিন্য এড়িয়ে চলুন। কোষ্ঠকাঠিন্যের ফলে মলত্যাগের সময় পেটের দেওয়ালে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। প্রচুর তরল পান করুন, ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খান এবং নিয়মিত ব্যায়াম করুন। আরও পড়ুন