আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছে যার মধ্যে একবার হলেও এই প্রশ্নটি মাথায় এসেছে যে, আসলে সেক্স করলে কি হয়? আপনি যা জানেন শারীরিক মিলন সম্পর্কে তা কি পর্যাপ্ত নাকি আপনার জানার বাইরেও রয়েছে অনেক অজানা তথ্য?
স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক মধুর আর এই সম্পর্ক আরো মধুর হয় যখন তারা একে অপরের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে লিপ্ত হয়। তবে আপনি কি জানেন যে মিলনের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক ভাবে একে অপরের মধ্যে কি কি পরিবর্তন আসে? কতটা উপকার হয়? আসুন এই আর্টিকেলের মাধ্যমে জেনে নেই সেক্স করলে কি হয়।
সেক্স করলে কি হয়? শরীরিক ও মানসিক পরিবর্তন সমূহ
সেক্স বা শারীরিক মিলন কিংবা যৌনমিলন যে নামেই ডাকা হোক না কেনো এটি আমাদের জীবনের স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক অংশ। যদিও শারীরিক মিলন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধ্যানধারণা রয়েছে, এর পেছনে লুকিয়ে থাকা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া এবং তার পরবর্তী সময়ে শরীরে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনগুলি কম-বেশি সকলের জন্যই আকর্ষণীয়।
এই আর্টিকেলে আমরা জানাবো সেক্স করলে কি হয়? মিলনের সময় এবং পরবর্তী সময়ে পুরুষ ও মহিলাদের শরীরে কী ঘটে এবং এ সম্পর্কে কিছু চমকপ্রদ তথ্য তুলে ধরবো।
শারীরিক মিলনের সময় পুরুষের শরীরে ঘটে যাওয়া পরিবর্তন
শারীরিক মিলনের সময় পুরুষের শরীরে বিভিন্ন ধরণের পরিবর্তন ঘটে। শারীরিক উত্তেজনার একটি পর্যায়ে এসে পুরুষের শরীর ejaculatory inevitability নামে পরিচিত একটি অবস্থায় পৌঁছে যায়। এই পর্যায়ে, শরীরের পালস রেট এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় এবং বীর্য নির্গত হয়। এই সময় পুরুষাঙ্গ সংকোচন হয় এবং শরীর ধীরে ধীরে শিথিল হতে শুরু করে।
যৌনমিলনের পর, বেশিরভাগ পুরুষ কিছু সময়ের জন্য শিথিল হয়ে ঘুমানোর প্রবণতা প্রকাশ করে। বিজ্ঞান বলছে, এই প্রবণতা স্বাভাবিক এবং শরীরের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার অংশ। শারীরিক উত্তেজনার সময় শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে উদ্বেগ নির্গত হয়, যা ক্লান্তির অনুভূতি তৈরি করে। এছাড়াও, যৌনমিলনের সময় মস্তিষ্ক থেকে নির্গত হওয়া বিভিন্ন রসায়নিক (যেমন – সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন, নরএপিনেফ্রিন, ভ্যাসোপ্রেসিন এবং নাইট্রিক অক্সাইড) শরীরকে শিথিল করতে সাহায্য করে।
শারীরিক মিলনের পর অনেক পুরুষ ঘুমিয়ে পড়ে, যা একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া। এই ঘুমের পিছনে মূল কারণ হলো প্রোল্যাকটিন নামক একটি হরমোন যা মিলনের পর শরীর থেকে নির্গত হয়। এই হরমোন শরীরকে তৃপ্তির অনুভূতি দেয় এবং ঘুমানোর প্রবণতা বাড়ায়। মিলনের পরে শরীরে এই হরমোনের পরিমাণ কম থাকলে, একজন পুরুষ দ্রুত আবার যৌন উত্তেজনায় ফিরে।
মিলনের পর পুরুষদের মধ্যে আরেকটি সাধারণ প্রবণতা হলো প্রস্রাবের জন্য বাথরুমে যাওয়া। এটি শরীরের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার অংশ এবং অক্সিটোসিন ও প্রোল্যাকটিনের কারণে ঘটে। এই রসায়নগুলি কিডনিতে প্রভাব ফেলে, যা প্রস্রাবের প্রয়োজন সৃষ্টি করে তবে প্রস্রাব আসে না। কারণ মিলনের সময় অভ্যন্তরীণ স্ফিঙ্কটার পেশী সংকুচিত হয়ে থাকে, যা প্রস্রাবের রাস্তা বন্ধ করে রাখে।
শারীরিক মিলনের পর নারীর শরীরে ঘটে যাওয়া পরিবর্তন
নারীদের শরীরে যৌনমিলনের সময় এবং পরে বেশ কিছু শারীরিক প্রতিক্রিয়া ঘটে। পুরুষদের তুলনায় নারীদের ক্ষেত্রে এই প্রতিক্রিয়া গুলো কিছুটা ভিন্ন হয়। মিলনের পর নারীদের শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে, যেমন তাদের স্তনগুলি ফুলে উঠতে পারে এবং ক্লিটোরিস সংকুচিত হয়ে পড়ে। কিছু নারী মিলনের পর অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত বা আরও আত্মবিশ্বাসী বোধ করতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ পুরুষদের তুলনায় নারীরা মিলনের পর হতাশাগ্রস্ত বোধ করেন না।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের প্রায় ৫০% যৌনমিলনের সময় নিয়মিতভাবে অর্গ্যাজম বা পরম তৃপ্তি লাভ করেন, ২০% নারীরা খুব কম অর্গ্যাজম অনুভব করেন, ২০% নিয়মিত অর্গ্যাজম অনুভব করেন এবং ৫% নারীর কখনও অর্গ্যাজম হয় না। [১] [২] [৩]
নারীদের অর্গ্যাজমের সময় তীব্র স্নায়বিক সংকোচন ঘটে, যা তাদের বিশেষ অঙ্গ, গর্ভাশয়, মলদ্বার এবং শ্রোণীতে প্রচণ্ড উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এছাড়াও, নারীরা মিল্কি স্রাবের মাধ্যমে “ফিমেল এজাকুলেশন” হয়ে থাকে।
মিলনের পর নারী ও পুরুষের মানসিক প্রতিক্রিয়া
একত্রে মিলনের পর, নারীদের মাঝে সম্পর্কের বিষয়ে কথা বলার প্রবণতা দেখা যায়। এটি তাদের মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা এবং হিপোক্যাম্পাসের কারণে ঘটে। এটি যৌন উত্তেজনার সময় নিষ্ক্রিয় থাকে এবং অর্গ্যাজমের পর পুনরায় শুরু হয়। নারীদের জন্য, যৌনমিলনের পর অক্সিটোসিন (যাকে “কাডল কেমিক্যাল” বলা হয়) নির্গত হয়, যা দুইজনের সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলতে সহায়তা করে।
পুরুষদের ক্ষেত্রে, উচ্চ মাত্রার টেস্টোস্টেরনের কারণে অক্সিটোসিনের পরিমাণ কম নির্গত হয়, এটি তাদের তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ায়। তবে, কিছু ক্ষেত্রে বহুগুণ অর্গ্যাজম হয় এবং মিলনের পরপরই আবার উত্তেজনায় ফিরতে সক্ষম হয়।
সেক্স করলে কি হয়? জানুন ১০টি উপকারিতা সম্পর্কে
স্বামী স্ত্রীর একত্রে মিলন শুধুমাত্র আনন্দ বা প্রজননের একটি মাধ্যম নয়, বরং এটি শরীরের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উপর একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমরা অনেকেই জানি না যে নিয়মিত এবং সুস্থ মিলনের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা পাওয়া যায়। চলুন, এবার জেনে নেয়া যাক সেক্স করলে কি হয় তথা স্বামী স্ত্রীর একত্রে অন্তরঙ্গ মিলন করার উপরকারিতা কি সে সম্পর্কে।
১. স্ট্রেস এবং উদ্বেগ হ্রাস করে
অন্তরঙ্গ সম্পর্কের মাধ্যমে স্ট্রেস এবং উদ্বেগ হ্রাস পায়। যখন স্বামী স্ত্রী একত্রে আনন্দ বা অর্গাজম উপভোগ করে, তখন শরীরে ‘ইনর্ফিনেস’ নামক একটি হ্যাপি হরমোন নির্গত হয়। এই হরমোনটি উদ্বেগ এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে, যা আমাদের মনকে প্রশান্ত করে এবং ভালো ঘুম নিশ্চিত করে। এটি শরীরে একটি সাধারণ স্বস্তি ও আনন্দের অনুভূতি এনে দেয়, যা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২. হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
অন্তরঙ্গ সম্পর্ক কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমকে সচল করে তোলে। অন্তরঙ্গ সম্পর্কের সময় আমাদের হৃদস্পন্দন বাড়ে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয়। এটি হৃদপিণ্ডকে শক্তিশালী করে তোলে এবং শরীরের এনার্জির চাহিদা মেটায়। ফলে, নিয়মিত মিলন হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
৩. আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে
মিলনের মাধ্যমে ভালোবাসা এবং প্রশংসার অনুভূতি পাওয়া যায়, এটি আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। যখন আমরা অনুভব করি যে কেউ আমাদের ভালোবাসে এবং আমাদের মূল্য দেয়, তখন নিজেকে আরও বেশি ভালোবাসতে শিখি। এটি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী এবং আমাদের সামাজিক জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৪. ত্বককে সুন্দর করে তোলে
অন্তরঙ্গ সম্পর্কের সময় একটি বিশেষ ধরনের হরমোন নির্গত হয়, যা ত্বককে আর্দ্রতা দেয় এবং অভ্যন্তরীণভাবে পুষ্টি যোগায়। এটি ত্বকের বলিরেখা কমিয়ে ত্বককে মসৃণ এবং উজ্জ্বল করে তোলে। তাই নিয়মিত মিলনের মাধ্যমে ত্বকের সৌন্দর্য ধরে রাখা যায়।
৫. ক্যালরি বার্ন করে
অন্তরঙ্গ সম্পর্ক এক ধরনের শারীরিক ব্যায়াম হিসেবে কাজ করে। যত বেশি মিলন করা হয়, তত বেশি ক্যালরি শেষ করা সম্ভব। বিশেষ করে যারা ওজন কমানোর চিন্তা করছেন, তাদের জন্য একত্রে মিলন একটি কার্যকরী মাধ্যম। এছাড়া, মিলনের পর সন্তুষ্টি আমাদের চকলেট বা অন্যান্য মিষ্টি খাবারের আকাঙ্ক্ষা কমিয়ে দেয় যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি।
৬. ভালো ঘুম নিশ্চিত করে
Intimate হওয়া ঘুমের জন্য অত্যন্ত উপকারী। মিলনের সময় নির্গত হরমোন গুলো আমাদের মনকে শান্ত করে এবং গভীর ও বিশ্রামপ্রদ ঘুম নিশ্চিত করে। যারা অনিদ্রা বা ঘুমের সমস্যা ভুগছেন, তাদের জন্য শারীরিক একটি প্রাকৃতিক সমাধান হতে পারে।
৭. মাথাব্যথা এবং মাইগ্রেন কমায়
শারীরিক সম্পর্কের সময় শরীরে নাইট্রিক অক্সাইড নির্গত হয়, যা রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে। এটি আমাদের মাথাব্যথা এবং মাইগ্রেন কমাতে সাহায্য করে। তাই, শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে সাধারণ মাথাব্যথা এবং মাইগ্রেনের তীব্রতা কমানো সম্ভব।
৮. প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
নিয়মিত শারীরিক সম্পর্ক পুরুষ এবং মহিলাদের প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক। এটি মহিলাদের মাসিক চক্র নিয়মিত রাখতে সাহায্য করে, যা গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ায়।
৯. হাড়ের শক্তি বৃদ্ধি করে
শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে শরীরে হরমোনের নির্গমন ঘটে, যা হাড়ের ঘনত্ব ধরে রাখতে সাহায্য করে। এটি হাড়ের ক্ষয় রোধ করে এবং অস্টিওপোরোসিসের মতো রোগের ঝুঁকি কমায়। তাই, নিয়মিত শারীরিক সম্পর্ক হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী।
১০. মূত্রাশয় নিয়ন্ত্রণ উন্নত করে
শারীরিক সম্পর্কের সময় পেলভিক মাংসপেশি সক্রিয় থাকে, এটি মূলত মূত্রাশয় নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত শারীরিক সম্পর্ক মূত্রাশয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং প্রস্রাবের সমস্যার ঝুঁকি কমায়।
চুড়ান্ত মন্তব্য
এর পরেও যদি আপনার মনে প্রশ্ন আসে যে, “সেক্স করলে কি হয়?” তবে উত্তর হবে “একে অপরের প্রতি ঘনিষ্টতা, আগ্রহ, ভালোবাসা ও নির্ভরতা বাড়িয়ে দেয়” তবে শারীরিক সম্পর্কের উপকারিতা শুধুমাত্র মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি আমাদের সামগ্রিক জীবনের মান উন্নত করতে সাহায্য করে। তবে, সুস্থ এবং নিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শারীরিক সম্পর্ক বা অন্তরঙ্গ মিলনের সময় এবং পরবর্তী সময়ে শরীরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন পরিবর্তন আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং খুব সতর্কতার সাথে এগুলো উপভোগ ও নিয়ন্ত্রন করা উচিৎ। মিলন শুধু শারীরিক নয়, মানসিক সুস্থতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। আপনাকে শুভকামণা দেয়ার মাধ্যমে আর্টিকেলটির ইতি টানছি।